সাম্প্রতিক মহামারী জীবনের প্রায় প্রতিটি বিষয়েই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভ্যাস বদলে দিয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলো তো বটেই, সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছে খুব সম্ভবত শিক্ষাখাতে। এই মহামারীর অনিশ্চিত সময়ে যে পরিমাণ নতুন নতুন অনলাইন ক্লাস এবং ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা দেশ দেখেছে তা অভূতপূর্ব। সিনিয়র থেকে শুরু করে জুনিয়র, সকল পর্যায়ের শিক্ষকেরাই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার সাথে। অন্যদিকে একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতিনিয়ত শিক্ষাগ্রহণ করেছে অনলাইনে।
সব মিলিয়ে হঠাৎই আসা এ পরিবর্তন এক নতুন শঙ্কা এবং প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সবাইকে। আর তা হল, এই যে হঠাৎ সবকিছু অনলাইনে শিফট হয়ে গেল, এর জন্য কি প্রস্তুত আমরা সবাই? হুট করে যে অনলাইনে এত এত শিক্ষা আদান-প্রদান হচ্ছে, ক্লাস হচ্ছে, বাচ্চা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন, সব মিলিয়ে শিক্ষাখাতে সাইবার সিকিউরিটি আসলে কতটা নিশ্চিত করা সম্ভব এত দ্রুত?
এডুকেশনাল টেকনোলজি (এডটেক) বা প্রযুক্তিশিক্ষণের এই বাস্তবতায় শিক্ষাখাতের অনলাইন নিরাপত্তা সচেতনতা নিয়েই তাই আজকের লেখা। দেশ এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি শিক্ষণের চ্যালেঞ্জ, অপার সম্ভাবনা ও বিনিয়োগ, কেন শিক্ষাখাত এমন সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে এসব নিয়েই এই লেখাটি সাজানো।
অনলাইনে পঠন এবং মূল্যায়ন, ধারণাটি বেশ আগে থেকেই ছিল। ভবিষ্যতের এই শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রদূত হতে অনেক বড় বড় কোম্পানি বিশাল বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছিল। খান অ্যাকাডেমির মত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই অনলাইন শিক্ষার পথ দেখিয়ে আসছিল। প্রযুক্তিখাতের অগ্রদূতদের একজন, বিল গেটস সেই ২০১৩ সালেই খান অ্যাকাডেমির প্রশংসা করে বলেছিলেন আগামীদিনের শিক্ষাব্যবস্থা হবে এমনই!
সবাই বলছে ২০২০ এ করোনা মহামারির কারণে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা বেগবান হয়েছে। অথচ এর আগের বছর অর্থ্যাৎ ২০১৯ সালে প্রযুক্তিশিক্ষণ খাতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ছিল ১৮.৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর মহামারীর কারণে এখাতে এসেছে অচিন্তনীয় এক বিপ্লব। এখাতের বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন আগামী বছর ২০১৯ সালের তুলনায় বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি বিনিয়োগ আসবে যার পরিমাণ প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রযুক্তিশিক্ষণের কথা উঠলে কিন্তু বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বরং বেশ কিছু নতুন নতুন স্টার্টআপ এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলা যায় শিক্ষক ডট কম এর কথা। অনেকটা খান অ্যাকাডেমির আদলে ২০১২ সালে গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ বিনামূল্যের এই প্রযুক্তিশিক্ষণ ওয়েবসাইটটির ট্যাগ লাইনই হল বাংলায় অনলাইনে মুক্ত জ্ঞানের মেলা। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ১০ মিনিট স্কুলও একটি সফল এডটেক স্টার্টআপ যা প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া ই-শিখন, শিখবে সবাই, শিখো ডট কম ইত্যাদি ওয়েবসাইটও বেশ ভালো কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক রিপোর্ট অনুসারে এই মহামারীর কারণে বিশ্বের ১৮৬টি দেশের প্রায় ১২০ কোটি শিশু-কিশোর তাদের ক্লাসরুমে ক্লাস করার সুযোগ হারিয়েছে। এদের অনেকেই প্রথমবারের মত পরিচিত হয়েছে অনলাইন ক্লাসের মত কার্যক্রমের সাথে। আর এখানেই চলে আসছে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জের কথা। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে শিক্ষার্থীরা সনাতন ক্লাসরুমের চাইতে আধুনিক ডিজিটাল ক্লাসরুমে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং আরও আগ্রহ নিয়ে বেশি বেশি শিখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল, সব কিছুর সাথেই থাকে মানিয়ে নেয়ার বিষয়টি।
অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য এই নতুন পদ্ধতির সাথে মানিয়ে নেয়াটা অনেকাংশেই সহজ ছিল। তবে দূর্ভাগ্যজনকভাবে তুলনামূলক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আবার একই বিষয় সত্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও। তুলনামূলক তরুণ শিক্ষক-শিক্ষিকারা সহজেই অনলাইন শিক্ষাপ্রদানে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও তুলনামূলক সিনিয়র শিক্ষকদের বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়েছে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে বাগে আনতে।
অন্যদিকে শহরাঞ্চলের তুলনামূলক উন্নত স্কুলগুলোতে অনলাইনে ক্লাস সংক্রান্ত কিছুটা সেটআপ থাকলেও সব জায়গায় তা নেই। আর গড়পড়তা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেখানে সব ধরণের খরচ মেলাতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে আসলে আইটি কিংবা সাইবার সিকিউরিটিতে বরাদ্দের কথা ভাবা অলীক কল্পনাই বলা চলে। আর এরমধ্যেই অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে শতগুণ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় খুবই নাজুক। এই খাতটি এখন সবচেয়ে বেশি সাইবার আক্রমণের আশংকায় রয়েছে। সাইবার ক্রিমিনালরা সহজ শিকার হিসেবে টার্গেট করছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই। তাই শিক্ষাখাতে সাইবার সিকিউরিটি এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পূর্বে যেমনটা বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইবার অ্যাটাকের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগিরি র্যানসমওয়ার অ্যাটাকের শিকার হয়ে ২০হাজার কানাডিয়ান ডলার পরিশোধ করেছে বলে খবরে প্রকাশ পেয়েছে। কানাডিয়ান আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়, সাইমন ফ্রেশার ইউনিভার্সিটি ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বীকার করে যে, তাদের সার্ভারে ডাটা ব্রিচ হয়েছে এবং প্রায় ২লক্ষ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য ফাঁস হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার একটি স্কুলে সাইবার এটাকের ফলে স্কুলের পুরো অনলাইন সিস্টেম ক্রাশ করে যা পরবর্তীতে কয়েকদিন কাজ করে নতুন করে দাড়া করাতে হয়।
এর বাইরে বিখ্যাত ক্লাউড কম্পিউটিং প্রোভাইডার ব্ল্যাকবাউড (Blackbaud) -এ সাইবার এটাকের ফলে যুক্তরাজ্যের বেশকিছু স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিবিসি ২০২০ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে ইউনিভার্সিটি অফ লিডস, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজের মত প্রতিষ্ঠান এই সাইবার অ্যাটাকে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায় রয়েছে।
কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এত সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে? কেন শিক্ষাখাতে সাইবার সিকিউরিটি এত জরুরি? নিচে কিছু কারণ উল্লেখ করা হল
বাজেট তথা অর্থের সীমাবদ্ধতাঃ
যেমনটি আগেই বলা হয়েছে সাধারণত শিক্ষাখাতে সাইবার সিকিউরিটি হল কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাওয়া ক্ষেত্র। অন্যান্য খাতের চাহিদা মিটিয়ে এই সাইবার খাতে বরাদ্দের মত তাই কিছুই অবশিষ্ট থাকে না বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। আর আইটি খাতে এই পরোক্ষ অবহেলা একে আরও বেশি দূর্বল করে তোলে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
নির্দিষ্ট আইটি পলিসির অনুপস্থিতি
এই সমস্যাটি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় বরং আরো বড় পরিসরে পরিলক্ষিত হয়। যেহেতু সাইবার সিকিউরিটি খাতে বিনিয়োগ থাকে সবসময়ই কম, তাই সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যার কিংবা সাইবার সিকিউরিটিতে এক্সপার্ট লোকেরও স্বল্পতা থাকে। ফলে স্বভাবতই একটি পরিপূর্ণ এবং শক্তিশালী নেটওয়ার্ক পলিসি প্রণয়ন ও প্রয়োগের অনুপস্থিতি থাকে কেননা প্রয়োগ তো পরের কথা, এমন একটি পরিপূর্ণ আইটি পলিসির ডিজাইন করাই অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। তাই অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠান চলতে কোন সুনির্দিষ্ট আইটি পলিসি ছাড়াই এবং একটি সাইবার অ্যাটাক হবার আগে কারোই টনক নড়ে না।
কিছু প্রচলিত অভ্যাস
কিছু প্রচলিত অভ্যাসও অনেক সময় পুরো সাইবার সিকিউরিটির ব্যাপারটিকে আরো জটিল করে তোলে। যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই প্রচলিত একটি ব্যাপার হল নিজ নিজ পিসি কর্মস্থলে নিয়ে আসা। এমনিতেই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নেই সিকিউরিটি এক্সপার্ট, তার উপর এমন ওপেন, পাবলিক পিসি নেটওয়ার্কে কানেক্ট হয়ে গেলে বিষয়টি আরো বেশি নাজুক হয়ে দাঁড়ায়। এত বিশাল নেটওয়ার্কের সিকিউরিটি নিশ্চিত করা তাই প্রায় অসম্ভবের নামান্তর।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্পর্কিত সাইবার অ্যাটাক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাইবার অপরাধীদের জন্য সহজ শিকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে শিক্ষাখাতে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে তাই গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে।